বড় চোর আর ছিঁচকে চোরে
দেশের ভাবমূর্তি সংকটাপন্ন।।
একটা গল্প দিয়ে প্রবেশ করি।গল্পটা চাল চোর ও ডাকাতের। এক বাড়িতে একই সাথে চোর ডাকাত হানা দেয়। চাল চোর সিঁধ কেটে চালের ঢোলে ঢুকে বস্তায় চাল ভরতেছে এমন সময় বাড়ির মালিক ও তার বুদ্ধিমতি বউয়ের ঘুম ভাঙে ঠিক একই সময়ে ডাকাতদল ও দরজা ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্রুত বাড়ির মালিক টাকা পয়সা ও সোনা গহনা নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।দরজা ভেঙে ডাকাত ঢুকে মালিকের বউকে জিজ্ঞেস করল, বাড়ির মালিক কোথায়? বউ ভয় পাওয়ার ভান করে বলে দিলেন আপনাদের ভয়ে চালের ঢোলে লুকিয়েছে। ডাকাতরা বাড়ির মালিক মনে করে চাল চুরকে বের করে আনলেন এবং টাকাপয়সা ও সোনা গহনার খোঁজ দেয়ার জন্য পিটাইতে লাগলো। কে শুনে কার কথা। এদিকে বাড়ির মালিক বাইরে গিয়ে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করাতে পাড়ার মানুষ চলে আসলে ডাকাতরা পালিয়ে গেল ততক্ষণে চাল চোরের আধমরা অবস্থা। থিমঃ চাল চোরেরা ধরা খায় ডাকাত পালিয়ে যায় যাইহোক এবার মুল আলোচনায় আসি।
গোড়ায় গলদ, বিসমিল্লাহ তে ভুল করলে গাঁজন নষ্ট হওয়ার সম্ভবনাই বেশি থাকে যা আমাদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে দুর্নীতির সূচনা হয় রিলিফ দুর্নীতি দিয়ে। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে দুঃখ করে বলতে হয়েছিল: ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।
শীতকালে দেশ স্বাধীন হওয়ায় শীতের হাত থেকে বেঁচে গৃহহীন মানুষের ঘুমানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল কম্বলের। কম্বল বেশি এসেছিল এ কারণে।আর ওই কম্বল যাদের দেয়ার কথা, তাদের না দিয়ে রিলিফ চেয়ারম্যানরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছিলেন। এসব জেনে বঙ্গবন্ধু কষ্ট পেয়ে বলেছিলেন: ‘আমার কম্বলটা কই?’ এ কারণে ৭০-এর দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘কম্বলচোরা’ প্রবচনটির জন্ম হয়।
আজব একটা দেশ, যেদেশে চোর নিয়ে প্রচলন আছে হরেক রকমের প্রবাদ প্রবচন।পৃথিবীর কোন দেশে চোর নিয়ে এত প্রবাদ আপনি পাবেন বলে আমার মনে হয় না
কম্বলচোরা
পুকুরচুরি
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে
চোরের মার বড় গলা
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
যার জন্য করি চুরি সে বলে চুর
চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড় ধরা
রাজনীতির চোরাবালি
চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি
চোরের সাক্ষী মাতাল
অতিভক্তি চোরের লক্ষণ
চুরি আসলে এক ‘চমৎকার’ আর্ট। কমবেশি অনেকেই এ বিদ্যা চর্চা করে। কিন্তু ধরা পড়ে খুব কম জনই। আর এর সুবিধা হলো, ধরা না পড়া পর্যন্ত কাউকে চোর বলাও যায় না! চুরিটা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে, এ নিয়ে কেউ তেমন আর মাথা ঘামায় না। তবে মাঝেমধ্যে দু একটি বড় চুরির ঘটনা ধরা পড়ে বা উদ্ঘাটিত হয়। তখন আমরা খানিকটা হইচই করি। ধর্মের বাণী স্মরণ করি। ব্যস। তারপর যেই লাউ সেই কদু। আমরা আবার চুরির মওকা খুঁজি। চুরি বিদ্যার চর্চা অব্যাহত রাখি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ নানা দিক থেকেই অনন্য, অসাধারণ। চুরি করে বড়লোক হওয়ার মতো এমন সুন্দর অনুকূল পরিবেশ পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। তাইতো এখানে কমবেশি সবাই বড়োলোক হবার বাসনায় চুরি করেন। ঘুষ খান, দুর্নীতি করেন।
অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আমাদের দেশে টাকা উপার্জন অনেকেই করেন। শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাদের মধ্যে ধরা পড়ে কজন? ঢাকা শহরের এমন অনেক আলিশান বাড়ি ও দামি গাড়ির মালিকদের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের এ অর্জন অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির টাকায়। এরটা মেরে, ওরটা কেড়ে, ঠকিয়ে-প্রতারণা করে, বিপদের সুযোগ নিয়ে, ফাঁসিয়ে দিয়ে কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথ ছাড়া এদেশে বড় ধনী হওয়া যায় না। আর সেটা সবাই পারেও না। আসলে টাকা উপার্জন করাটা যেমন একটা আর্ট, উপার্জিত টাকা সকলের অগোচরে ‘সংরক্ষণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ’ করতে পারাটাও একটা আর্ট। এই আর্ট সবাই রপ্ত করতে পারে না। এর জন্য সাধনা লাগে। দক্ষতা অর্জন করতে হয়। ম্যানেজ করতে জানতে হয়। পুকুর চুরি করে সেই পুকুর আড়াল করে রাখা বা গায়েব করে দেওয়াটা সহজ বিদ্যা নয় মোটেই। অনেকেই সেটা পারেন এবং করেন। কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু কিছু আনাড়ি চোরও আছে। যেমন এই চাল চোরগণ। ‘আড়াল করবার বিদ্যা’ অর্জন ছাড়াই যেভাবে চাল চোররা ধরা পড়ছেন, তাতে লোকগুলোর প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। সামান্য কয়েক বস্তা চাল যারা ‘গোপন’ বা ‘হজম’ করতে পারে না, ম্যানেজ করতে পারে না, তাদের আসলেই কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত! হাত-পা ভেঙে তিন রাস্তার মোড়ে খাঁচায় ভরে রাখা উচিত! যাতে তাদের দেখে অন্যসব শিক্ষানবিস চোর শিখতে পারে যে, চুরি করলেই কেবল হবে না, চোরাই মাল ‘হাপিস’ করে দেবার দক্ষতা আগে অর্জন করতে হবে।
এইসব আনাড়ি চোরের কারণে দেশ এবং সরকারের ভাবমূর্তির বারোটা বাজছে। অথচ যারা কঠিন-কঠোর মানি লন্ডারিং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সরকার-প্রশাসন-গোয়েন্দা-গণমাধ্যমকে ভেড়া বানিয়ে অত্যন্ত কৌশলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে, বিভিন্ন দেশে দোকান-বাড়ি-জায়গা জমি কিনছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লেখাপড়ার নামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তারা কিন্তু চিহ্নিত হচ্ছে না। এতে দেশের ভাবমূর্তিরও কোনো রকমফের হচ্ছে না! এদের কাছে শেখার আছে অনেক কিছু। কিন্তু এই আনাড়ি চাল চোরেরা কিছু শিখেছে বলে মনে হয় না। তা না হলে এই ঘোর করোনাকালে সামান্য কয়েক বস্তা চাল কেউ বলদের মতো চুরি করতে যায়?
কিসের রবীন্দ্রনাথ, কিসের পিকাসো, আমাদের দেশে অধরা অনির্ণীত বড় বড় চোরেরাই প্রকৃত ‘আর্টিস্ট’। প্রকৃত শিল্পীসত্তা। অসম্ভব শিল্পিত কায়দায় যারা ব্যাংক থেকে, শেয়ার বাজার থেকে, বিদ্যুৎ থেকে, আমদানি-রপ্তানির নামে সকলের অজান্তে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছেন, রাষ্ট্রের চেয়েও যারা বেশি ক্ষমতাবান, আসলে তারাই মানুষ তারাই দেবতা!
ধিক! শতধিক! নিন্দা তাদের তরে।
যারা এই করোনা মহামারিতে ত্রান চুরি করে।।
গাহি তাদের গান,
পুকুরচুরি করে সমুদ্র চুরি করে
আজীবন থাকে যার মান সম্মান।।
মুহাম্মদ আইয়ুব আলী
লেকচারার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
কক্সবাজার সরকারি কলেজ।
Leave a Reply